মহাকারুণিক তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভের পর রাজা বিম্বিসার নির্মিত বেণুবন বিহারে অবস্থান করছিলেন। বহুজনের হিতের জন্য বহুজনের মঙ্গলের জন্য ধর্মসুধা বিতরণ করে চলেছেন।
এদিকে রাজা শুদ্ধোধন দীর্ঘ সাত বছর ধরে পুত্রকে দেখেননি সুতরাং তিনি পুত্রকে দর্শনের জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। সিদ্ধার্থ পুত্র রাহুলের বয়স এখন সাত বছর। রাহুলের জন্মের পরপরই পিতা সংসার ত্যাগ করায় তার পিতাকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি।
শাক্যরাজ শুদ্ধোধন পুত্রকে রাজগৃহে আনতে তার একজন মন্ত্রীকে ১০০০ সৈন্যসহ বেণুবন বিহারে পাঠালেন। মোট ৬০ যোজন পথ অতিক্রম করে তিনি যখন বেণুবনে পৌঁছলেন, দেখতে পেলেন বুদ্ধ তখন দিব্যজ্যোতি বিকিরণ করে ভক্তদের মধ্যে দেশনা প্রদান করছেন। এই শান্ত সৌম্য পরিবেশ ও বুদ্ধের অপূর্ব জ্যোতি দেখে রাজা শুদ্ধোধনের কথা ভুলে গেলেন। তিনি একপ্রান্তে বসে ধর্মদেশনা শ্রবণে মনোযোগী হয়ে পড়লেন এবং দেশনা শেষে অরহত্ত্ব ফল প্রাপ্ত হলেন। তখন তিনি বুদ্ধের নিকট প্রব্রজ্যা হবার অনুমতি প্রার্থনা করলেন, বুদ্ধ এস ভিক্ষু বলে দীক্ষা প্রদান করলেন। এদিকে রাজা শুদ্ধোধন অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে দ্বিতীয় একজন মন্ত্রীকে সমপরিমাণ সৈন্যসহ বেণুবনে পাঠালেন। তিনি ও তথাগথ বুদ্ধের অমৃতময় দেশনা শুনে প্রথমজনের মত সঙ্গীসহ বুদ্ধের শিষ্যত্ব বরণ করলেন। রাজার সংবাদ আর উত্থাপন করলেন না। এভাবে রাজা শুদ্ধোধন ১০০১ জন করে সর্বমোট ৯০০৯ জন লোক বেণুবনে প্রেরণ করেছিলেন পুত্র দর্শনের আশায়। কিন্তু কেহই ফিরে এলেন না। সবাই বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে অরহত্ত্ব ফল প্রাপ্ত হয়ে নির্বাণ সুখ উপলব্ধি করছেন।
অবশেষ রাজা খুবই ব্যথিত ও হতাশ হয়ে বুদ্ধের জন্মসঙ্গী কালুদায়ীকে অনুরোধ করে বললেন, “হে প্রিয় কালুদায়ী, তুমি বেণুবনে গিয়ে যে কোন উপায়ে আমার ছেলে বুদ্ধকে কপিলাবস্তু নিয়ে আসবে। পূর্বে পাঠানো সবাই প্রব্রজিত হয়ে বুদ্ধের শিষ্য হয়ে গেছে। তোমার যদি প্ৰব্যজ্যা গ্রহণের ইচ্ছা হয় আমার কোন আপত্তি থাকবে না। তবে আমার প্রিয় পুত্র বুদ্ধকে ফাং করে তুমি কপিলাবস্তু আনার ব্যবস্থা করবে এবং এক হাজার সঙ্গী দিয়ে রাজগৃহের বেণুবনে প্রেরণ করলেন।
মন্ত্রী কালুদায়ী বেণুবনে পৌঁছে ষড়রশ্মি বিচ্ছুরিত অপূর্ব প্রজ্ঞাশ্বর বর্ণে আলোকিত জগতজ্যোতি বুদ্ধকে দর্শন করে এক অনাস্বাদিত আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বুদ্ধের চরণ বন্দনা করলেন। বুদ্ধ তাঁকেও দেশনা করলেন। কিন্তু তিনি রাজা শুদ্ধোধনের কথা ভুলে যাননি। সুযোগ বুঝে তিনি ৬৪টি গাথার মাধ্যমে অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট ও ছন্দময় ভাষায় রাজা শুদ্ধোধনের প্রার্থনা বুদ্ধের নিকট ব্যক্ত করলেন। বুদ্ধকে তিনি আরও বললেন, “প্রভু বুদ্ধ! আপনার বৃদ্ধ পিতা রাজা শুদ্ধোধন আপনাকে দর্শন করার জন্য বড়ই আগ্রহী। তদুপরি আপনার জ্ঞাতিবর্গের মধ্যে ধর্মসুধা বিতরণ করে তাদেরকে উদ্ধার করা উচিত। কালুদায়ীর ফাং বুদ্ধ গ্রহণ করে বিশ হাজার শিষ্যকে নিয়ে কপিলাবস্তু যাবার প্রস্তুতি নিতে আদেশ দিলেন। দিনে এক যোজন পথ অতিক্রম করে ৬০ দিনে কপিলাবস্তু পৌঁছেন।
পিতা শুদ্ধোধনকে ধর্মদানঃ বুদ্ধের আগমন সংবাদ পেয়ে রাজা শুদ্ধোধন শাক্যবংশীয় রাজাদের সাথে আলোচনা করে বুদ্ধকে যথোচিত সংবর্ধনা প্রদানের জন্য নিগ্রোধ উদ্যানকে বুদ্ধ ও সংঘের বসবাসের উপযোগী করে সাজিয়ে রাখলেন। অতঃপর স্ব-পরিষদ বুদ্ধকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য বিচিত্র বসন-ভূষণে অলংকৃত শিশু-কিশোরদেরকে পুরোভাগে রাখলেন। তরুণ-তরুণী, রাজকুমার-রাজকুমারী ও বয়ষ্করা নানাবিধ পূজা উপকরণ সহ ন্যাগ্রোধ আরামে এসে উপস্থিত হলেন। ২০ হাজার শিষ্যসহ মহাকারুণিক বুদ্ধ ন্যাগ্রোধ আরামে এসে উপস্থিত হলেন এবং বুদ্ধাসনে উপবেশন করলেন। শাক্যজাতি স্বভাবতই অত্যন্ত অভিমানী ও বংশকূলের গৌরব করে থাকে। বুদ্ধের চাইতে যারা বয়সে অগ্র যেমন কাকা, মামা, জেঠা তারা একপাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীদের যারা বুদ্ধের কনিষ্ঠজন তাদেরকে সামনে গিয়ে বুদ্ধকে অভিবাদন জানাবার নির্দেশ দিলেন। তারা বুদ্ধের বুদ্ধত্বকে বয়সের মাপকাঠি দিয়ে বিচার করবার চেষ্টা করলেন।
ভগবান বুদ্ধ দিব্যচক্ষু দ্বারা শাক্যদের মনোভাব বুঝতে পেরে চিন্তা করলেন, আমার জ্ঞাতিগণ দেখছি স্বেচ্ছায় আমাকে শ্রদ্ধা ও বন্দনা জানাবেন না কারণ আমাকে জানবার জ্ঞান তাদের নেই। তাই তিনি ঋদ্ধি উৎপাদনকারী চতুর্থ ধ্যানে মগ্ন হলেন। পরে ধ্যান ভঙ্গ করতঃ আকাশে উত্থিত হয়ে গন্ডা বৃক্ষতলে প্রদর্শিত যমক ঋদ্ধির ন্যায় অলৌকিক ঋদ্ধি শক্তি প্রদর্শন করেন। সে অদ্ভুদ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে রাজা শুদ্ধোধন বললেন, ”ঋষি কালদেবল আপনার প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়ে আপনার পদযুগল তার শিরােপরি স্থাপিত দেখে আমি আপনাকে প্রথম বন্দনা করেছিলাম। হলকর্ষণ উৎসবে জম্বুবৃক্ষের ছায়াতলে উপবিষ্ট অবস্থায় আপনার ঋদ্ধিশক্তি দেখে দ্বিতীয় বার বন্দনা করেছিলাম। এখন আপনার অভূতপূর্ব ঋদ্ধি প্রদর্শন দেখে আপনাকে তৃতীয়বার বন্দনা করছি।”
রাজা শুদ্ধোধন যখন এভাবে বুদ্ধকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলেন কপিলাবস্তুবাসী একজন শাক্যও বুদ্ধকে বন্দনা না করে থাকতে পারলেন না। একে একে সকলেই প্রণাম করতে বাধ্য হলেন। অভমানী হাতিদেরকে এভাবে শিক্ষা দিয়ে বুদ্ধ আকাশ হতে অবতরণপূর্বক নির্দিষ্ট আসনে উপবিষ্ট হলেন। সেসময় অদ্ভুত আবহাওয়া সৃষ্টি হয়ে আকাশ হতে জলধারা বর্ষিত হল। যারা সিক্ত হতে চাইলে তারা সকলেই সিক্ত হল। আর যারা চাইল না তাদের গায়ে একফোঁটা জলও পড়ল না। তথাগত বুদ্ধ অধিষ্ঠান করে পৃথিবী থেকে অকনিটঠক্ষক্ষ্মলোক পর্যন্ত আলোকিত করলেন। আকাশে রত্নময় চংক্রমণ সোপান রচনা করতঃ মণিমুক্ত কনিকাকীর্ণ সমুদিত সূৰ্য্যরে ন্যায় সর্বদিক উদ্ভাষিত করেছিলেন। সমবেত জনসাধারণ, কামসুগতি স্বর্গের দেবগণ, গন্ধর্ব যক্ষ নাগ রাক্ষস, কিন্নরী, দশসহস্র চক্রবালবাসী দিব্য মন্দার ও পারিজাত পুষ্প বর্ষণ করতে লাগল বিশ্বব্রহ্মান্ড প্রকম্পিত করে সাধুবাদ প্রদান করছিল।
এই আশ্চৰ্যজনক কান্ড দেখে সবাই বলাবলি করতে লাগল, বুদ্ধের কি অসাধারণ আশ্চর্য অদ্ভুদ ঋদ্ধিশক্তি। তখন বুদ্ধ অতীত জন্মের বেশ্বান্তর জাতকের বর্ণনা শোনালেন। অতঃপর বুদ্ধ কপিলাবস্তুতে অবস্থানের দ্বিতীয় দিনে ২০ হাজার ক্ষীণাস্রব ভিক্ষুসহ ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করতে দেখা গেল। রাজা শুদ্ধোধন বেদনাহত হয়ে বুদ্ধের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে বললেন, ”আমার রাজবংশে কখনও কেউ ভিক্ষা করেনি। ভগবান আপনি আমাকে কেন অপমান করছেন? আপনিতো আমাকে বড়ই লজ্জা দিলেন। উত্তরে বুদ্ধ বললেন, আপনার রাজবংশ কোনদিন ভিক্ষা করে নাই কথাটি সত্য কিন্তু আমার বংশ আলাদা। আমার বুদ্ধ বংশের প্রথা হচ্ছে ভিক্ষান্ন দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করা।
অতঃপর অগ্রশ্রাবক সারীপুত্র স্থবিরের অনুরোধক্রমে ভগবান কপিলাবস্তুবাসীদের উদ্দেশ্যে ধর্মদেশনা করলেন। রাজাকে লক্ষ্য করে বুদ্ধ বললেন, ধর্ম চরে সুচরিতং, ন নং দুচ্চরিতং চরে, ধর্মাচারী সুখং সেতি, অম্মিং লোকে পরমিহ। অর্থাৎ ভিক্ষুগণের পাপ অকুশলহীন, ধর্মত ভিক্ষান্নে গমন অভ্যাস করতে হয়। উক্ত অভ্যাস পাপ অকুশল অধর্মত পথে আচরণ করা অনুচিত। যারা এভাবে অকুশল বর্জিত ধর্মপথে ভিক্ষান্নে গমন করে। জীবনধারণ করেন তারা ইহ ও পরলোকে উভয়লোকে সুখী হন। এই গাথা শ্রবণে রাজা শুদ্ধোধন অতীত জন্মের কুশল পারমী হেতু সকৃদাগামী মার্গফল লাভ করলেন এবং সেখানে উপস্থিত বুদ্ধের মাসী মহাপ্রজাপতি গৌতমী স্রোতাপত্তি মার্গফলে প্রতিষ্ঠিত হলেন।
পরদিন রাজপ্রাসাদে দুপুরের ছোয়াইং গ্রহণের জন্য বুদ্ধকে ফাং করলেন। যথাসময়ে ভোজনালয়ে উপস্থিত হয়ে ছোয়াইং ভোজন শেষ হলে যশোধরা পুত্র রাহুলকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন। বুদ্ধকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ”স্বর্ণময় দেহকান্তি, ব্রক্ষার ন্যায় ঋজু দেহধারী উনি তোমার পিতা, তোমার পিতার নিকট হতে তুমি উত্তরাধিকার ধন চেয়ে নাও। তোমার পিতার সংসার ত্যাগ করার পূর্বে শঙ্খ, এল, উপপল ও পুন্ডরিক নামের চারটি সপ্তরত্ন পরিপূর্ণ বিরাট পাত্র ছিল কিন্তু তোমার পিতার সংসার ত্যাগের পর ঐ পাত্রগুলো আর দেখছি না। তুমি চক্রবর্তী রাজা হতে চাও বলে তোমার পিতাকে বল। রাজা হতে ঐ ধনরাশি তোমার প্রয়োজন। উত্তরাধিকার সূত্রে ঐ ধনরাশি তোমার প্রাপ্য। তুমি এখন ঐ ধন দাবী কর। বুদ্ধ ভোজন শেষে নিগ্রোধারাম অভিমুখে চলে যাচ্ছেন দেখে রাহুল বললেন আমাকে উত্তরাধিকার ধন দিন। এই বলে বুদ্ধের পেছন পেছন যেতে লাগল। বুদ্ধ তখন ধর্ম সেনাপতিকে ডেকে বললেন, সারীপুত্র রাহুল আমার কাছে উত্তরাধিকার ধন চায়। লৌকিক উত্তরাধিকার ধনসম্পদ অসার ও দুঃখময়। তাই তাঁকে উত্তরাধিকার ধন হিসাবে প্রব্রজ্যা প্রদান কর। বুদ্ধের আদেশে রাজপুত্র রাহুলকে উপাধ্যায় হিসাবে ভদন্ত সারীপুত্র প্রব্রজ্যাচর্যা হিসাবে ভদন্ত মৌদগল্যায়ন এবং উপদেশদাতা গুরু হিসেবে ভদন্ত মহাকশ্যপ এই তিন মহারথী রাহুলকে প্রব্রজ্যা দেন। রাজপুত্র রাহুল হয়ে গেলেন বুদ্ধপুত্র শ্রমণ রাহুল। বলাচলে ফাল্গুনী পূর্ণিমা তথাগত বুদ্ধের পারিবারিক পূণর্মিলনের দিন।।
সাধু🙏 সাধু🙏 সাধু🙏
লেখক: লায়ন উজ্জ্বল কান্তি বড়ুয়া, লেখক, সংগঠক ও মানবিক কর্মী।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Suprobhat Michigan